- 24 August, 2023
- 0 Comment(s)
- 286 view(s)
- লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
ঘটনা, তার পরেকার ঘটনা – এবং তারও পরেকার ঘটনা, এভাবেই আজকের নিবন্ধকে সাজাতে চাইব। শুরুর ঘটনাটিকে প্রাথমিক ভাবে দেখলে, তাতে নতুনত্ব প্রায় কিছুই নেই বলা চলে। ন্যাশনাল ক্রাইম রিপোর্ট ব্যুরোর তরফে প্রকাশিত একাধিক সমীক্ষা-আলোচনার পর একথা আজ অঙ্কের হিসেবেই প্রমাণিত, এই দেশে নারী বা শিশুদের উপর যত সংখ্যক লাঞ্ছনা বা নির্যাতনের ঘটনা ঘটে থাকে, বা সেই বিষয়ক অভিযোগ উঠে আসে – অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেগুলির পিছনে অভিযুক্ত হিসেবেও উঠে আসেন তাদের পরিচিত মানুষেরাই। পরিচিত মানুষেরাই সবচেয়ে বেশি করে নারী ও শিশুদের অসম্মানের কারণ হন। কাজেই দিল্লির সাম্প্রতিক ঘটনায় আশ্রয়দাতা পিতৃতুল্য মানুষটির হাতেই যে নাবালিকা মেয়েটিকে নির্যাতিত হতে হয়েছে, এই তথ্য বোধহয় আমাদের অতখানিও অবাক করতে পারে না। আমরা অবাক হই তখন, যখন আমরা জানতে পারি সেই ধৃত পুরুষের পেশাগত পরিচয়। আমরা এক জঘন্য বিস্ময়ের সঙ্গে অবগত হই, ধৃত প্রেমোদয় খাখা পেশাগত ভাবে দিল্লি সরকারের নারী ও শিশুকল্যাণ দপ্তরের একজন সহকারী অধ্যক্ষ বা ডেপুটি ডায়রেক্টর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি বিশেষ ভাবে শিশুরক্ষা, শিশুকল্যাণ, জুভেনাইল জাস্টিস এ্যাক্ট এমনকি পকসো এ্যাক্ট বা শিশুদের উপর যৌননির্যাতন বিরোধী যে আইন, সেই আইনের বিষয়েই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিশেষজ্ঞ ছিলেন ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মচারীদের সেই বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্যও তিনিই দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। আজ পকসো ধারাতেই তাঁকে ও তাঁর স্ত্রীকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ, সংক্ষিপ্ত আকারে তা এখানে বিবৃত করা প্রয়োজন।
নাবালিকা ষোলো বছরের মেয়েটি তার বাবার মৃত্যুর পর ২০২০ সালে প্রেমোদয় খাখার বাড়িতে আশ্রয় নেয়। জানা যাচ্ছে, প্রেমোদয় তার বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন, তাই সেই বন্ধুর অকালপ্রয়াণের পর প্রেমোদয় নিজেই বন্ধুকন্যার ভরণপোষণের ভার নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। নভেম্বর ২০২০ থেকে জানুয়ারি ২০২১ অবধি টানা সময় ধরে প্রেমোদয় তাকে ধর্ষণ করেন। সেই সময় একাধিকবারে মেয়েটি গর্ভবতী হয়ে পড়ে। প্রেমোদয়ের স্ত্রী স্বামীর সহযোগী হিসেবে মেয়েটিকে গর্ভনিরোধক ওষুধ খাওয়ান, ও গর্ভপাতেরও ব্যবস্থা করেন। গর্ভপাতের এমন একটি ঘটনার পর মেয়েটি মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং অবস্থার বাড়াবাড়ি দেখে প্রেমোদয় ও তাঁর স্ত্রী তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে বাধ্য হন। হাসপাতালে কাউন্সেলিং চলার সময় মেয়েটি চিকিৎসকদের কাছে নিজের মানসিক অবস্থার কথা জানায় এবং তার কারণগুলিও বিবৃত করে। এরপরই দিল্লি পুলিশের তরফে গত ১৩ই আগস্ট এফআইআর দায়ের করা হয়। যদিও, প্রেমোদয় ও তাঁর স্ত্রীকে গ্রেফতার করতে আরও এক সপ্তাহ সময় পেরিয়ে যায়।
নারী ও শিশুকল্যাণ বিভাগেরই একজন পদস্থ আধিকারিক, পকসো আইন বিষয়েই যাঁর ব্যুৎপত্তি ও প্রশিক্ষণ, তাঁরই তরফে এমন জঘন্য এক ঘটনা – তদুপরি, তাঁর স্ত্রীর তরফেও তাঁকে সম্পূর্ণরূপে মদত দিয়ে আসা – আমরা এই বাস্তবতারই সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছি।
অভিযুক্ত প্রেমোদয়কে তাঁর পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। দিল্লি পুলিশের তরফে অভিযুক্ত ও তাঁর স্ত্রীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রশ্ন হল, পকসো আইন অনুসারে যেখানে এফআইআর দায়েরের পর মুহূর্তমাত্র সময় নষ্ট না করে অভিযুক্তকে গ্রেফতারের নির্দেশ রয়েছে, সে হেন অবস্থায় দিল্লি পুলিশের কেন অভিযুক্তকে হেফাজতে নিতে আটদিন সময় লাগল? উচ্চপদে আসীন এই সরকারি আধিকারিক কি তাহলে এই বিষয়ে নিজের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছিলেন? এই সমস্ত প্রশ্ন উঠে আসার প্রেক্ষিতে দিল্লি মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন স্বাতী মালিওয়াল নির্যাতিতা মেয়েটির সঙ্গে দেখা করতে চেয়ে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে পৌঁছন। দিল্লি পুলিশের তরফে তাঁকে মেয়েটির সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। এমনকি নির্যাতিতার মায়ের সঙ্গেও স্বাতীকে দেখা করতে দিতে পুলিশ বাধা দেয় বলে অভিযোগ। সংবাদমাধ্যমের কাছে স্বাতী অভিযোগ করেন, কেবল যে মেয়েটির সঙ্গে দেখা করতেই পুলিশ বাধা দিচ্ছে তা নয়, মেয়েটির মায়ের সঙ্গেও স্বাতীকে কথা বলতে দেওয়া হচ্ছে না। তদুপরি তিনি আরও অভিযোগ করেন, কেন্দ্রীয় শিশু অধিকার রক্ষা কমিশনের চেয়ারপার্সন প্রিয়াঙ্ক কানুনগোকে পিছনের দরজা দিয়ে হাসপাতালে নিয়ে এসে নির্যাতিতার মায়ের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেওয়া হয়েছে। মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন হিসেবে নির্যাতিতা মেয়েটি বা তার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে না দেওয়ার প্রতিবাদে স্বাতী মালিওয়াল হাসপাতাল চত্বরেই ধর্ণায় বসেন। এই হল ঘটনার পরেকার ঘটনা।
২১শে আগস্ট সোমবার, দুপুর ১২টা থেকে মঙ্গলবার, ২২শে আগস্ট দুপুর অবধি ধর্ণা জারি রাখলেও স্বাতীকে নির্যাতিতা মেয়েটির সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। কেবল তাই নয়, অবাক হয়ে দেখেছি, সরকারি মদতপুষ্ট সংবাদমাধ্যম এএনআইয়ের তরফে রাতভর দিল্লি মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন, স্বাতী মালিওয়ালের এই হাসপাতালে ধর্ণার বিষয়টি যখন সামাজিক মাধ্যমে তুলে ধরা হয়, দায়িত্ব নিয়ে সংবাদমাধ্যমের তরফে হাসপাতালের মেঝেয় শোয়া, ঘুমন্ত স্বাতীর ছবিটিই নানা কৌণিক অবস্থান থেকে ফুটেজবন্দী করে প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। একজন ঘুমন্ত মহিলার ছবি তাঁর অনুমতি বিনা এভাবে ক্যামেরাবন্দী করে জনসমক্ষে প্রচার করার যে ঔদ্ধত্য, (নাকি বলব নির্লজ্জতা ?) তা ঠিক কোন ধরনের work ethics বা কার্যনীতির আওতায় পড়ে, জানা নেই আমার। সর্বোপরি এই প্রসঙ্গে, সরকারি মদতপুষ্ট সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত সেই খবরের তলায় মুখরোচক যে সমস্ত মন্তব্যেরও বন্যা বয়ে যেতে দেখলাম, তা দেখলেও শরীর ও মন অসুস্থ হয়ে পড়ে। রুচির অভাবও বোধকরি এর চেয়ে বেশি শালীন। গত কয়েক বছরে, কেন্দ্রীয় সরকারের দালালি করতে সবসময়ে ব্যস্ত থাকা, যে অদ্ভুৎ, অবাক এক বিকৃত সমাজব্যবস্থার আমরা জন্ম হতে দেখেছি, পুরুষতন্ত্রের ত্রিশূলধারী সেই গণ-উন্মত্ততাকে যখন প্রতিটি বার এভাবে সামাজিক মাধ্যমে নগ্নরূপে উন্মোচিত হতে দেখি, শ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায়। এতখানি অশালীন তো আমরা ছিলাম না? এতখানিই কি কদর্য ছিল আমাদের মন? উগ্র পুরুষতন্ত্রের ধ্বজাবাহক সরকারের শাসনপ্রতিষ্ঠা মাত্রই যা কি না তার নখদাঁত নিয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছে। এই উপলব্ধি রাতের চেয়েও অন্ধকার।
আমরা এই খবরগুলিকে নিয়ে উত্তর-সম্পাদকীয় লিখব। হয়তো বা মুহূর্তের বিস্ময় প্রকাশ করব ঘটনার নৃশংসতায়। অবাক হয়ে ভাবব, পেশাদার মানুষটির এমন আচরণের বিষয়ে। কিন্তু পরপর সূত্র সাজিয়ে, আমরা কি ভাবতে চাইব, পেশাদার মানুষটির এই ক্ষমাহীন আচরণ – তার পরবর্তীতে নিজে মেয়ে হয়েও তাঁর স্ত্রীর তরফে তাঁর পাশে দাঁড়ানো ও অপরাধে সহযোগিতা করা – সংবাদমাধ্যমের তরফে আরেক মহিলার ঘুমন্ত অবস্থায় বিশ্রামের ছবি প্রকাশ্য পরিসরে সম্প্রচার করা – এবং, সাধারণ জনতার তরফে সেই ছবি ও মহিলাকে নিয়ে কদর্য, রুচিহীন আলোচনা ... আর ঠিক কতখানি অবক্ষয় আমাদের জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে?
[সামাজিক মাধ্যমেরই এক আলোচনায় ছবি হিসেবে উঠে আসতে দেখেছিলাম, পাশাপাশি দুই সরকারেরই তরফে নারীসুরক্ষার ক্ষেত্রে দুইটি বিশেষ অবদানঃ
ভূতপূর্ব সরকারের আমলে নির্ভয়া গণধর্ষণ কাণ্ডে সাংসদ ও জনপ্রতিনিধি রাহুল গান্ধী বিন্দুমাত্র আত্মপ্রচারের চেষ্টা না করে, গোপনে নির্যাতিতার ভাইয়ের পাশে দাঁড়ান। রাহুলেরই পৃষ্ঠপোষকতায় বর্তমানে সে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বৈমানিক হিসেবে কর্মরত।
আর, বর্তমান সরকারের আমলে উত্তরপ্রদেশের উন্নাওয়ে একটি গণধর্ষণের মামলায় আলোড়ন সৃষ্টি হয় যখন, নির্যাতিতা-সহ তার গোটা পরিবারকেই পরিকল্পিত দুর্ঘটনা ও আক্রমণের মাধ্যমে হত্যার ব্যবস্থা করা হয়। সাক্ষ্য দেবার ক্ষেত্রে সেই পরিবারের আর কেউই আজ জীবিত নেই।]
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বোধহয় ঠিকই বলেছিলেন, শোচ পালটিয়ে গিয়েছে আজ ... এমনই ‘শোচ’ যা কিনা শৌচালয়ের জঞ্জালের চেয়েও অন্ধকার!
0 Comments
Post Comment